চিল্কা হ্রদের তীরে এই ছোট নৌকো ঘাটটার একপাশে সবুজ ঘাসের ওপর অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। মাছধরা নৌকোটার ফিরে আসার অপেক্ষায়। ঠিক বসে আছি বললে ভুল হবে। কচি নরম ঘাসের ওপর শরীরকে এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ঊপভোগ করছি। কখনও নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে নানারকমের বক ও পাখি উড়ে চলেছে হ্রদের মাঝে নলবন দ্বীপে। সূদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পাখিগুলো সারা শীতকালটা চিল্কায় কাটিয়ে আবার ফিরে যাবে নিজেদের দেশে। অবশ্য সকলে নয়। পাখি শিকারীদের হাতে যারা ধরা পড়বে, তারা ছাড়া অন্য সবাই। হয়ত নানা রাজ্যের গ্রাম শহরের উপর দিয়ে উড়ে আসার সময় ওদের অনেক উঁচু আকাশের পথ ধরতে হয়েছে। গুলি গুলতি অথবা তীর বর্শার আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু চিল্কায় পৌঁছে নলবন দেখতে পেয়ে বোধহয় ওদের আনন্দ ও সাহসের সীমা নেই। গ্রীস্মকালের সাইবেরিয়ার জলাভুমি ও শীতকালের চিল্কা বা ভারতের আরও বহু বড় পুকুর, হ্রদ ও নদীতীরের নলখাগড়ার জঙ্গল, সবইএদের আপন দেশ। তাই নলবনে নামার আগে ক্যাঁক ক্যাঁক আওয়াজ দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। একই সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা। দ্বীপের উপর ভাল জায়গা দখল করার জন্যে।
কখনও চেয়ে থাকি চিল্কার কালো জল, কালো নৌকো ও কালো জেলেদের দিকে। ম্যাকারেল, চিংড়ি ও কাঁকড়া ধরার আর এক প্রতিযোগিতা চলে এই জেলেদের মধ্যে। অবশ্য গভীর জলে। হাঁটু ডোবা জলে কোমরে খালুই বাঁধা চুপড়ি হাতে আর একদল জেলে। শেওলা পানার মধ্যে চুপড়ি ডুবিয়ে এরাও ঘুরে বেড়াচ্ছে কাঁকড়া, কাছিম ও চিংড়ির খোঁজে।
প্রায় এগারশো বর্গ কিলমিটার জুড়ে চিল্কাহ্রদ। ঠিক হ্রদ নয় ল্যাগুন বা উপহ্রদ। উড়িষ্যার উপকুলে বঙ্গপসাগরের সঙ্গে জোড়া লাগানো। পুরী ও গঞ্জাম জেলার বহু গ্রাম গঞ্জ ছুয়ে। পুরী অথবা ভুবনেশ্বর থেকে ওয়াল্টেয়ার বা চেন্নাই যাওয়ার পথে খুড়দা পেরিয়ে আরও চল্লিশ কিলোমিটার অতিক্রম করার পরই চিল্কার এলাকা। কালুপাড়া ঘাট থেকে রম্ভা পর্যন্ত ছাপান্ন কিলোমিটার উপকুল বরাবর সাতটা স্টেশন। মাঝখানে পাচটা। কুহুরি, গঙ্গাধরপুর, বালুগাঁ, চিল্কা ও খালিকোট। বালুগাঁ স্টেশনের কাছেই বরকুল পান্থনিবাস।
উড়িষ্যা ভ্রমণে এসে অনেকেই পুরী, কোনার্ক ও ভুবনেশ্বর দর্শন করে বাড়ি ফিরে যান। কিছু সংখ্যক মানুষ, যাঁরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে নির্জন সমুদ্র সৈকত অথবা প্রকৃতির এক মনোরম শান্ত পরিবেশে দু চারটে দিন কাটাতে চান, অতি অবশ্যই গঞ্জাম জেলার গোপালপুর ও চিল্কায় আসেন।
আমার ব্যাপার আলাদা। বহুকাল ধরে প্রায় সারা বছরই পথে পথে ঘুরে বেড়াই। পথ চলার ক্লান্তি দূর করি পথের ওপরেই পরিচিত অপরিচিত জায়গায় বিশ্রাম করে। প্রচীন বা নবীন নগর উপনগরে শুধু ঘুরে বেড়াই। চিল্কার বা গোপালপুরের মত নির্জন, শান্ত ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে থমকে যাই পা যেন আর চলতে চাইছে না। শুয়ে বসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। প্রাচীন রাজা বাদশাদের কীর্তিস্তম্ভের ধবংস্তুপ দর্শনের মানসিক ক্লান্তি মন থেকে বিদায় নেয়।
এবার তা হল না। কেন জানি না। মনের মধ্যে শুধু ঐ এক চিন্তা। নৌকোটা কখন ফিরে আসে। নৌকোর জন্যে নয়। ঐ ছোট ছেলেটার জন্যে। নৌকো নিয়ে সে একাই গেছে। হ্রদের মাঝে নলবনের দ্বীপের কাছে। আগের দিন গোপনে পেতে রাখা জালটা তুলে আনতে। দেরি হলে, মাছ ও জাল কিছুই পাওয়া যাবে না। জলে স্থলে সব জায়গায়তেই চোর ঘুরে বেড়ায়।
খেয়াঘাটে ছেলেটার কাছ থেকেই ঘটনাটা জানতে পারলাম। ওর বাবা মাছ ধরার জন্যে আগের দিন নৌকো নিয়ে বেরিয়েছিলাম। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায় জাল পেতে রেখে বাড়ি ফিরে এসেছেন। ইচ্ছে ছিল, পরদিন গিয়ে জালটা তুলে নিয়ে আসার। কিন্তু পারলেন না। জরে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছেন। যার কানাকড়িও নেই, মাটির কলসী, বেতের খালুই ও বাঁশের চুপড়ি ছাড়া। একমাত্র সম্বল ঐ নৌকো ও মাছধরা জাল। তাও মহাজনের নেওয়া কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকা খেপে খেপে শোধ করলেই সব চলে যায়।
-----তুমি একা নৌকো চালিয়ে অতদূর গিয়ে জালটা তুলে আনতে পারবে?
কাদায় নেমে নৌকোটার দড়ি খুলতে খুলতে বেশ বিজ্ঞের মত বলল, কি করব বাবু? গরিব মানুষ। সব অভ্যাস আছে।
তের চৌদ্দ বছরের বেশি নয়। কালো লিকলিকে লম্বাটে শরীর। মাথায় একরাশ কালো কোঁকড়া চুল। টিকালো নাকের ওপর দুপাশে টানা বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল চোখ। সারা মুখে আত্মপ্রত্যয় ও সাহসের ছাপ। ওর কথা শুনে মনে হল, কাজে নিশ্চয়ই সফল হবে। লম্বা বাঁশ জলের মধ্যে ডুবিয়ে নৌকটায় ঠেলা মেরে ধীরে ধীরে গভীর জলের দিকে চলে গেল। রীতিমত অভিজ্ঞ মাঝির কায়দায়।
চিল্কার হ্রদের মাঝে ও তীরের কাছাকাছি অনেক দেখার জায়গা। পুরনো মন্দির ও রাজপ্রাসাদেরও অভাব নেই। নন্দম মৌর্য, চেদী, চালুকা, রাষ্ট্রকূট, কেশরী, গঙ্গা, মারাঠা প্রভৃতি বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু রাজত্ব ছাড়া কলিঙ্গ বা উড়িষ্যা বহু বছর ধরে পাঠান মোগলদেরও অধীনে ছিল। অক্ষত মন্দির ও প্রাসাদের কাছে বসতি আছে বলে এগুলো দেখার জন্যে অনেকেই আসেন। কিন্তু উপকূলের অখ্যাত গ্রাম-গঞ্জের ঝোপ জঙ্গলে যে কত পুরনো ধ্বংসস্তূপে লুকিয়ে আছে তার হিসেব নেই।
চিল্কা বেড়াতে এসে যে সব জায়গায় সহজে যাওয়া যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো হল, রম্ভার কাছে নির্মলঝরে বিষ্ণূমন্দির ও নারায়ণীতে লক্ষ্মীমন্দির। মন্দির ছাড়াও পাহাড়ী নদী ও ঝর্ণা নিয়ে জায়গাগুলোর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
একিভাবে কয়েক ঘন্টা কেটে গেল। এর মধ্যে কাঁধের ঝোলা থেকে একটা গল্পের বই বার করে আধখানা পড়ে আবার ঝোলায় পুরে ফেলেছি। বসে বা শুয়ে থাকা অথবা ঘাসের ওপর পায়চারী করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। রাতটা বরকুল পান্থনিবাসে কাটিয়ে পরদিন সকালে বহরমপুরে হয়ে গোপালপুর যাওয়ার প্রোগ্রাম।
একসময় ঠান্ডা জলো বাতাসে আরাম লাগায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো পায়ের পাতায় কারও হাতের ছোঁয়া লাগায়।
ছেলেটা বসে আছে। দুহাতে দুটো বড় কাঁকড়া। কোলের কাছে একটা মাঝারি আকারের কাছিম। সবগুলোই জ্যান্ত।
--------বাবু এগুলো কিনবে?
--------জালটা পেয়েছিলে?
--------হ্যাঁ। সবটাই কাটা।
--------আর মাছ?
---------না। কাটা জাল থেকে সব বারিয়ে গেছে।
--------কাঁকড়া, কাছিম পেলে কোত্থেকে?
---------ঘাটের পাশে।
এত বড় দুর্ঘটনাতেও ছেলেটি ভেঙে পড়েনি। বাবা অসুস্থ। তাই ঘাটে ফিরে কাদাজল ও পাঁক হাতড়ে খালি হাতেই দুটো কাঁকড়া ও কাছিম ধরেছে। বিক্রি করে হয়তো বাবার জন্যে ওষুধ ও খাবার কিনে নিয়ে যাবে।
---------দাম কত?
---------একশ টাকা হয়। এরপর তুমি যা দেবে।
কাঁকড়া কাছিম নিয়ে কি করব, কিছু না ভেবেই ছেলেটার হাতে একশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও।
জোড়া কাঁকড়া ও কাছিমটাকে ঘাসের ওপর রেখে ছেলেটা চলে যেতে আমিও উঠে পড়লাম।
পান্থনিবাসের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছনে ফিরে ঐ খেয়াঘাটটার দিকে তাকালাম। কাছিম ও কাঁকড়া দুটো গুটি গুটি করে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
©MUKTI PADA CHOUDHURI
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন