ছোটদের প্রিয় গল্প

শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

পথে চলা গল্প বলা - উদয়গিরির বাঘ ভূত

 



দুপাশে দুই সবুজ পাহাড়। উত্তরদিকের পাহাড়টির নাম উদয়গিরি। মিষ্টি নাম।

পাহাগুলোর মাথায় ও সারা গায়ে ছড়ান প্রাচীন গুহা বা গুম্ফা। মৌচাকের মৌমাছির মত।
গুহাগুলোর বহু নাম। রানী গুম্ফা, গণেশ গুম্ফা। বাঘ গুম্ফা, হাতি গুম্ফা, অনন্ত গুম্ফা, মঞ্চপুরী গুম্ফা ও আরও কত কি!
এগুলো তৈরি হয়েছিল প্রায় দু হাজার বছর আগে। উড়িষ্যা বা প্রাচীন কলিঙ্গের জৈন রাজা খারাভেলার রাজত্বকালে। জৈন সাধুরা যাতে নিরাপদে ও নিশ্চিন্তমনে জপ ও পুজো নিয়ে দিন কাটাতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে।
চলতে চলতে ঘুরে ফিরে আবার উড়িষ্যার রাজধানী ভুবনেশ্বরে পৌঁছলাম। অতীত যুগের সেই বিখ্যাত কলিঙ্গনগরী। যার প্রাচীন ঐতিহ্য শুধু ভারতবর্ষ কেন, পৃথিবীর যে কোনও প্রাচীন রাজধানীর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। উড়িষ্যা আমার কাছে আরও বেশি প্রিয়, কারণ এই রাজ্যের অধিবাসীরা ভারতের অল্প সংখ্যক সরল ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের অন্যতম। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার চাহিদা বোধ হয় সবচেয়ে কম। আর হয়তো এই একটা কারণেই এই রাজ্যের অধিবাসীরা আমার কাছে পৃথিবীর সুসভ্য অধিবাসীদের অন্যতম। ভুবনেশ্বরকে কেন্দ্র করে দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বহু দেখার জিনিস।
কলিঙ্গের প্রাচীন রাজধানী শিশুপালগড়। মৌর্য সম্রাট অশোকের সঙ্গে কলিঙ্গরাজের যুদ্ব হয়েছিল যে প্রান্তরে সেই জায়গাটা, যার বর্তমান নাম ধওলি। লিংরাজ মন্দির ও প্রাচীন ভুবনেশ্বরের আরও বহু স্মারক, খণ্ডগিরি উদয়গিরি পাহাড়ের প্রস্তর - স্থাপত্য।
ভুবনেশ্বর থেকে অটো - রিক্সায় চড়ে খণ্ডগিরি-উদয়গিরি পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছতে সময় লাগে দশ থেকে পনের মিনিট। মাত্র সাত কিলোমিটার পথ।
আমি এসেছি সাইকেল-রিক্সায় চড়ে। সময় লেগেছে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আসলে পথ অতিক্রম করতে সময় যত বেশি লাগে, আমি খুশি হই তত বেশি। পথের দুপাশে সাজানো ঘরবাড়ি, ক্ষেতখামার, নদী প্রান্তর সবকিছু ভালভাবে দেখা যায়। এমনই অটো - রিক্সায় চড়তে ভয় পাই। লরি, বাস, ট্যাক্সিকে পাশ কাটিয়ে এমন বিপজ্জনকভাবে ছুটতে থাকে, মনে হয় এই বুঝি ধাক্কা লেগে মাথার খুলিটা ক্ষত-বিক্ষত হলেও উপায় নেই। আগে প্রাণ। পরে মাথার খুলি।
গাইড প্লীজ্‌?
বলে কি? ঐ পুচকে ছেলেটা কিনা গাইড?
কথা না বলে উদয়গিরি-পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। ছেলেটা পেছনে। মাঝে মাঝে দু-চারটে ইংরেজী শব্দ আওড়ে চলেছে। গাইড প্লীজ! হান্ড্রেড্‌ রুপীজ্‌।
খারাভেলার স্মৃতিবিজড়িত প্রস্তরপুরী। মহাবলীপূরমের প্রস্তরপুরীর মত। তবে উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি আরও বেশি সবুজ। ন্যাড়া পাথরের পাহাড় নয়।
রানী গুম্ফার সামনে দাঁড়িয়ে যখন দোতলা আকারের বাড়ির মত খারাভেলার সময়ে পাথর কেটে তৈরি গুহাগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, পেছন থেকে আওয়াজ এল, ওকে ফিফটি রুপীজ। জুড়ে টঙ্কা আজ্ঞা।
পেছনে মুখ ঘুরিয়ে দেখি ছেলেটা দাঁড়িয়ে হাসছে। ওর মুখে হাসি দেখে আমিও হেসে ফেললাম।
ব্যস! আর কথা নেই। এক লাফে কাছে এসে আমার হাত টেনে নিয়ে চলল গুহাগুলোর আরও কাছে। উড়িয়া, হিন্দি, ইংরেজি মিশিয়ে শুরু করল ওর বক্তৃতা। কখনও লাফ দিয়ে পাথরের ওপর উঠে, আবার কখনও একইভাবে নিচে নেমে।
গুহার আর শেষ নেই। খারাভেলা নাকি উদয়গিরি ও খণ্ডগিরি পাহড়ে একশ সতেরটা গুহা তৈরি করেছিলেন। এখন দুই পাহাড়ে মোট তেষট্টিতা গুহা দেখতে পাওয়া যায়। কাছেই নীলগিরি নামে একটা পাহাড়ে আরও তিনটে। খণ্ডগিরি মানে খণ্ড খণ্ড পাহাড়। তাই বর্তমান খণ্ডগিরি, উদয়গিরি ও নীলগিরি নিয়ে পুরো জায়গাটার নাম খণ্ডগিরি।
ছেলেটির কাছ থেকে ওর বাড়ির গল্প শুনলাম। বাবা পূজারী। সব সময়ে পূজোর কাজ পান না বলে ফুল বেলপাতা চন্দন ও বাতাসা ঝোলায় রেখে সকালে বেরিয়ে পড়েন। সারাদিন বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও বাজারে টহল দিয়ে যা পান তাতে স্ংসার চলে না। তাই ছেলেটি স্কুলের ছুটির পর খণ্ডগিরিতে এসে গাইডের কাজ করে রোজ এক -দুশো টাকা রোজগার করে। ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওর চেহারা দেখে মনে হয়েছিল টু-থ্রিতে পড়ে। নামটি অবশ্য বেশ বড়। দশরথ।
হাতি গুম্ফায় পৌঁছলাম। পাথর কেটে তৈরি গুহার দুপাশে দুটো পাথরের হাতি। ভেতরে পাথরের গায়ে খোদাই করা খারাভেলার শিলালিপি।
দশরথ বহু খবর রাখে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে খোদাই করা হাতিগুম্ফার এই শিলালিপি থেকে কলিঙ্গরাজ খারভেলার রাজত্ব সম্বন্ধে অনেক কিছু ঘটনা জানা গিয়েছে। সিংহাসনে বসার পর থেকে তের বছরের ঘটনার কোন সময়ে ঘটেছে এইসব বিবরণ।
তুমি এইসব ঘটনা জানলে কি করে ? পাথরের গায়ে ঐ হিজিবিজি লেখাগুলো পড়ে ? দশরথ কিছুক্ষণের জন্যে হাতির পিঠে বসেছিল। আমি নিচে দাঁড়িয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম ।
তিড়িং করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে বলল, দাদার কাছ থেকে ।
দাদা ? কই, আগে তো বলনি যে তোমার দাদা আছে ?
আমার কথা শুনে ওর মুখের চেহারা পাল্টে গেল । প্রথমে গম্ভীর ও তারপরে সারা মুখে রাগের ছাপ। খপ করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাঘগুম্ফার সামনে নিয়ে গিয়ে পাথর কেটে তৈরি বাঘের একটা বিশাল হাঁ করা মুখের দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে বলল, ঐ বাঘটা ! ওটাই আমার দাদাকে খেয়েছে ।
বললাম, সেকি ? ওটা তো পাথরের বাঘ ! পাথরের বাঘ কি মানুষ খায় ?
একটা পাথরের টুকরো তুলে বাঘের মুখটার দিকে ছুঁড়ে বলল, এই বাঘটা খায়।
মুহূর্তের মধ্যেই দু হাতের তালু দিয়ে মুখটা ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ব্যাপারটা বুঝলাম না। ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে একটু ঠাণ্ডা করতে কান্না বন্ধ করে তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে দুচোখ পরিষ্কার করল।
বাঘগুম্ফায় ওঠার সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে উঠে দশরথকে পাশে বসিয়ে ওর গল্প শুনলাম।
বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত ওর দাদা একইভাবে গাইডের কাজ করত। তখন সে ক্লাশ নাইনের ছাত্র।
সেদিন স্কুলের ছুটি। সারাদিন ধরে যাত্রীদের পেছনে ওপর নিচ করে বিকেলের দিকে বেশ কিছুটা ক্লান্ত। বাঘগুম্ফার সামনের চাতালে বসে ভাইকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। আরও কিছুক্ষণ দেখে সে বাড়ি ফিরে যাবে। যদি দু-একজন যাত্রী পাওয়া যায়।
আর ফেরেনি। অনেকে বলে, উদয়গিরি খণ্ডগিরি পাহাড়ে রাত্রির অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিচের জঙ্গলের গুপ্ত গুহাগুলো থেকে নানারকম জীবজন্তু বেরিয়ে এসে ওপরের অতি পরিচিত গুহাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বাঘ ভাল্লুক হায়নাও থাকে। আর গুহাগুলোর পাথরের জীবজন্তুরাও জ্যান্ত হয়ে ওদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ক্লান্ত ছেলেটি হয়ত চাতালের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। চিতাবাঘ বা হায়নায় তাকে টেনে নিয়ে গেছে।
ছোটভাই, মানে আমার খুদে গাইডটির বিশ্বাস, বাঘগুম্ফার ঐ পাথরের বাঘটা জ্যান্ত হয়ে উঠে তার দাদাকে নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলেচে।তাই পাথরের বাঘটার ওপর এত রাগ।
ওর হাতে একশো টাকার জায়গায় দুশো টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, তুমি আর অন্ধকারে এপাশে থেকো না। সন্ধে হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে যাও।
টাকাটা পেয়ে খুশি হওয়া সত্বেও ওর মুখটা গম্ভীর হল। বলল, বড় হয়ে সে রাইফেলধারী পুলিশের চাকরি করবে। তারপর এক রাত্রে রাইফেল নিয়ে বাঘগুম্ফার সামনে ঐ পাথরটার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে। পাথরের বাঘটা জ্যান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুড়ুম ! গুড়ুম ! বাছাধন আর কোনদিনই জ্যান্ত হবে না।
এর মধ্যে বহুবার ভুবনেশ্বর গিয়েছি। খণ্ডগিরি উদয়গিরি আর যাওয়া হয়নি। এই কয়েক্ বছরে দশরথ নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে। জানি না, সে রাইফেলধারী পুলিশ হয়ে দাদার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে উদয়গিরির ঐ বাঘভূতটাকে এতদিনে গুলি করে মেরে ফেলেছে কিনা।
©MUKTI PADA CHOUDHURI

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

পথে চলা গল্প বলা - চিল্কা্র খেয়াঘাটে

চিল্কা  হ্রদের তীরে এই ছোট নৌকো ঘাটটার একপাশে সবুজ ঘাসের ওপর অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি। মাছধরা নৌকোটার ফিরে আসার অপেক্ষায়। ঠিক বসে আছি বললে ভুল হ...